চবিজ্বালানি সরবরাহের সর্বোত্তম ব্যবস্থা নিতে হবে
দেশের জ্বালানি খাত নানাভাবেই বঞ্চনার শিকার হয়েছে। চাহিদামতো জ্বালানি সরবরাহ পাওয়া জনগণের মৌলিক অধিকার। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, জ্বালানিকে জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে কেউই স্বীকৃতি দিতে চান না। তাদের মতে, জ্বালানি মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়। বরং এর অবদান অনেকটাই পরোক্ষ। বলাবাহুল্য, মানুষের প্রত্যক্ষ মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণে জ্বালানি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। জ্বালানি খাতের মালিকানা যে নাগরিকদের, তা আমাদের সংবিধান কর্তৃক সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃত হয়েছে। কাজেই আমরা সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এটা দাবি করতে পারি যে, জ্বালানি খাতের ওপর রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের মালিকানা রয়েছে। জ্বালানি সম্পদ পাওয়ার অধিকার যেকোনো দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার।
এ ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান কী? অথবা সরকার কি জ্বালানি খাতের মালিক নয়? এ ধরনের প্রশ্ন আসতেই পারে। এর উত্তর হচ্ছে, সরকার কোনোভাবেই জ্বালানি সম্পদের মালিক নয়। সরকার জনগণের পক্ষ থেকে জ্বালানি খাতের সুরক্ষা বিধান করবে। জনগণের জন্য জ্বালানি সরবরাহের সর্বোত্তম ব্যবস্থা করবে। সরকার আমানতদার মাত্র, জ্বালানি খাতের মালিক নয়। তাই সরকারকে জ্বালানি খাতের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত অথবা কার্যব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে এ খাতে জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে।
জ্বালানি খাত-সংক্রান্ত যেসব চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়, তার দায়দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু বিগত সময়গুলোতে দেখা গেছে, আমাদের দেশের সরকার দায়বদ্ধতার বিষয়টি বিভিন্নভাবে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবজ্ঞা করে গেছে। এটা মারাত্মক অন্যায় এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোনো চুক্তি যদি দেশের জনগণের স্বার্থের পরিপন্থি হয়, তাহলে সে দায়ভার নিতে হবে সরকারকেই। সরকার চাইলে তার দায়বদ্ধতাকে আইনি মারপ্যাঁচে সুরক্ষা দিতে পারে। কিন্তু সেটা কোনো আদালতেই গ্রহণযোগ্য হবে না। সরকার এটা করতে ব্যর্থ হলে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, সময় কখনোই অপরাধের দায়মুক্তি দেয় না। কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে শত বছর পরও তার বিচার সম্ভব।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যখন ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসীন হয়, তখন সারা দেশে তীব্র জ্বালানিসংকট বিরাজ করছিল। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে কলকারখানা তথা উৎপাদন সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত সবাই বিশেষভাবে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে পড়েছিল। তারা চাহিদামতো গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলের সরবরাহ পাচ্ছিল না। গ্যাসের অনুসন্ধান ও উৎপাদন কার্যত বন্ধই ছিল। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, জ্বালানি পাওয়ার জন্য মানুষ দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতেও কুণ্ঠাবোধ করত না। সরকার জ্বালানি সম্পদকে রাষ্ট্রের অনুকূলে ও সমর্থনে লেনদেন করলেও সেখানে জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে। জ্বালানির জোগান চাহিদার তুলনায় অনেক কম হওয়ার কারণে ভুক্তভোগীরা যেকোনো মূল্যেই হোক জ্বালানির জোগান পেতে মরিয়া থাকে। সে সময় মানুষ জ্বালানি প্রাপ্তির বিপরীতে ছোটখাটো অন্যায় বা আইনবহির্ভূত পদক্ষেপকেই অনুমোদন দিতে রাজি ছিল। এ বিষয়টি উপলব্ধি করে তৎকালীন সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয় এবং তৎকালীন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটা প্রয়োজন ছিল।
এমতাবস্থায় দায়িত্ব গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ছিল, যত দ্রুত সম্ভব জ্বালানিসংকট দূরীকরণের জন্য কার্যকর ও বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সে সময় সরকার জ্বালানিসংকট নিরসনের লক্ষ্যে রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের জন্য ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের অনুমতি প্রদান করে। এ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বা ব্যবহার করে ব্যক্তি খাতে প্রচুরসংখ্যক পাওয়ার প্লান্ট স্থাপিত হতে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টগুলোর স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ছিল দেশের সার্বিক চাহিদার চেয়ে বেশি। এসব রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টকে বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। এ ক্যাপাসিটি চার্জ রাষ্ট্রীয় কোষাগার তথা জনগণের ট্যাক্সের অর্থ দিয়ে পরিশোধ করতে হয়। রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সাধারণ মানুষ এসব চুক্তির শর্তাবলি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানতে পারেনি।
জনগণ জ্বালানি খাতের একচ্ছত্র মালিক। কিন্তু তাদের অন্ধকারে রেখে যেকোনো চুক্তি স্বাক্ষর গর্হিত অন্যায় এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিগত সরকার জ্বালানি খাত নিয়ে এতকিছু করার পরও কার্যত এ খাতের অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বরং জ্বালানি খাতের পরিস্থিতি আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বিগত সরকারের মুনাফালোভী মনোভাব এবং অদূরদর্শী নীতিমালাই প্রধানত দায়ী। যারা জ্বালানি সরবরাহ ও নিয়ন্ত্রক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে কর্মরত আছেন, তাদের অনেকেই এ খাত থেকে অর্থ লুটে নিয়ে নিজেদের বিত্তবৈভব বৃদ্ধি করেছেন। জ্বালানি খাতের লুটকৃত অর্থ সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলেও পৌঁছে যেত বলে অভিযোগ রয়েছে। মনে রাখতে হবে, জ্বালানিপণ্য কোনো ব্যবসায়িক পণ্য নয়। এটা জনগণের নিত্যপণ্যের অন্তর্ভুক্ত। এবং এর প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু এর বিপরীতে আমরা কি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জোগান পেয়েছি? শতভাগ মানুষের জন্য বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার দাবি করা আর সবার জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জোগান নিশ্চিত করা ভিন্ন বিষয়। চাহিদার তুলনায় জোগান কম হওয়ার কারণে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হলেও জনগণ বাধ্য হয়ে তা মেনে নিচ্ছেন।
ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের সংকট তীব্রতর হয়। বিশ্বে প্রতিবছর যে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল উত্তোলন ও বিপণন করা হয়, তার ১ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশ রাশিয়া থেকে সরাসরি জ্বালানি তেল ক্রয় করতে পারেনি। যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার জ্বালানি তেল উত্তোলন ও রপ্তানি মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। এর প্রভাব পড়ে আন্তর্জাতিক বাজারে। জ্বালানি তেলের স্বাভাবিক জোগান বিঘ্নিত হওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ে। প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি সাংঘাতিকভাবে বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতেও জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্যবৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব লক্ষ করা যায়। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির বিরূপ প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই সীমিত আয়ের মানুষ। তারা এখনো কার্যত জ্বালানি শক্তির ওপর নির্ভরশীল। কোনো কারণে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেলে তাদের আর্থিক দুরবস্থা বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে, তখনো স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য সেভাবে কমানো হয়নি।
অভ্যন্তরীণ বাজারে উচ্চ মূল্যস্ফীতির পেছনে নানা কারণ থাকলেও সবচেয়ে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে জ্বালানি পণ্যের উচ্চমূল্য। আমাদের দেশে একটি প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যায়। তা হলো, কোনো সময় আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের মূল্য সামান্য বৃদ্ধি পেলে, সেই অজুহাতে স্থানীয় বাজারে পণ্যটির মূল্য আনুপাতিক হারের চেয়েও বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু কোনো সময় আন্তর্জাতিক বাজারে একটি পণ্যের মূল্য হ্রাস পেলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে তার কোনো ইতিবাচক প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায় না। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে সর্বশেষ অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হয়। সে সময় বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ উত্থাপিত হলে সরকারিভাবে বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্য ‘সমন্বয়’ করা হবে। এখানে কথার ম্যারপ্যাঁচ রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পেলে মূল্য সমন্বয়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মূল্য হ্রাস করা হবে, তা বলা হয়নি। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আগামী কিছুদিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য আরও হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জ্বালানি মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। জ্বালানি সরবরাহের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো কোনো মুনাফাখোর প্রতিষ্ঠান নয়। কাজেই যে কোনোভাবেই হোক, সহনীয় মূল্যে জনগণকে জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে। তাই প্রয়োজনে লোকসান দিয়ে হলেও তুলনামূলক স্বল্পমূল্যে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে জ্বালানির জোগান নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় বলা হয়, জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো হলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের লোকসান হবে। মনে রাখতে হবে, একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় সাধারণ মানুষের অর্থে এবং তা সাধারণ মানুষের কল্যাণে।
সেখানে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে ফেলে মুনাফা অর্জনের কোনো যুক্তি কি থাকতে পারে কী? বিগত সরকারের আমলের শেষের দিকে বিইআরসির গণশুনানি পদ্ধতি বাতিল করে নির্বাহী আদেশে জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থা করা হয়। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এর মাধ্যমে জ্বালানি খাতে অবাধ লুণ্ঠনের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিগত সরকারের জ্বালানিনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল কতিপয় মহলকে অর্থ লুণ্ঠনের সুযোগ করে দেওয়া। ছাত্র আন্দোলনের ফলস্বরূপ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পেয়েছে। তারা নিশ্চয়ই আগের সরকারের মতো জ্বালানি খাতে অদূরদর্শিতার পাশাপাশি মুনাফাখোর চরিত্র ধারণ করতে পারেন না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের চেতনা হচ্ছে সব ক্ষেত্রে অসমতা ও বৈষম্য দূরীকরণ। কাজেই সব ক্ষেত্রেই তারা সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করবেন এবং তা প্রথমেই জ্বালানি খাত থেকে শুরু করতে হবে।
লেখক: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক
ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা